মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলেই জন্ম প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের। সেই মানুষের মনেই এক সময় জন্ম নেয় ‘ভগবান’। যুগে যুগে যুগের দাবি মেনে আবির্ভুত হয় বিভিন্ন দেব-দেবীর। সেভাবেই আসেন দেবী দুর্গা। আমাদের আজকের আলোচনা সপ্তমী পুজোর দিন নব-পত্রিকা স্নান।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, এই নব পত্রিকা অর্থাৎ ৯টি গাছের পাতা। অর্থাৎ গাছ এখানে অবশ্যম্ভাবী । কিন্তু কেন গাছ? এখানেই বলা হয়, দুর্গা পুজো আদিতে প্রকৃতির পুজো, গাছের পুজো। এবার একটু সময়ের বিবর্তনের ইতিহাসে দিকে দেখতে হবে।
বহু বহু বছর আগে একটা সময় শরৎকালই ছিল শস্য সংগ্রহের সময়, মানে যাকে আমরা ‘হার্ভেস্ট’ বলে থাকি। তখন শরৎকালেই আমন ধান কাটা হত। আর মানুষ তখনও যেহেতু প্রকৃতি পুজোতেই অভ্যস্ত ছিল এবং মূর্তিপূজা সেভাবে জানতও না, তাই তারা শস্যসমৃদ্ধি প্রার্থনা করে এক লৌকিক দেবীর পুজো করত, বা বলা ভালো, সরাসরি প্রকৃতিরই পুজো করত। তখনও বাসন্তীপুজোই ছিল দুর্গাপুজো। যা পরে শরতে দুর্গাপুজো শুরু হলে তার পাশেই স্থান পায় সেই উদ্ভিদ-দেবী, তথা নবপত্রিকা।
এই নব পত্রিকা সম্পর্কে গবেষক অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত বলেন, ‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। … বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।’
সপ্তমীর ভোরে নবপত্রিকায় যে ন’টি গাছকে স্নান করানো হয়, সেগুলি হল– কলা গাছ, সাধারণ কচু, মানকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক এবং অবশ্যই ধান। এই ন’টি গাছ শস্যসমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পুরাকালের মানুষ। তাঁরা হয়তো কিছু ভেবেচিন্তেই এই গাছগুলি নির্বাচন করেছিলেন। পুরাণ মতে
নবপত্রিকার ন’টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার ন’টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত।
পুরানের ব্যাখ্যা হলো –
কলা : এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী।
কচু : এর অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা।
হলুদ বা হরিদ্রা: এর অধিষ্টাত্রী দেবী উমা।
জয়ন্তী: এর অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী।
বেল বা বিল্ব: এর অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা।
ডালিম বা বেদানা : এর অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা।
অশোক: এর অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা।
মানকচু: এর অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা।
ধান: এর অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।